ঢাকা ০৭:১০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে হাওর অর্থনীতি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:১৭:৪৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০১৯
  • ২৬১ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ হাওর হলো বৃহদাকার অগভীর জলাশয়। প্রাকৃতিকভাবে ভূগাঠনিক অবনমনের ফলে হাওরের সৃষ্টি। বর্ষাকালে এর জলরাশির ব্যাপ্তি কূলহীন সমুদ্রের আকার ধারণ করে। শীতকালে তা শুকিয়ে গিয়ে এবং সংকুচিত হয়ে দিগন্ত বিস্তৃত শ্যামল প্রান্তরে রূপ নেয়। বিভিন্ন কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি ও অর্থনীতিতে হাওর অনেক গুরুত্ব বহন করে। বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে হাওর দেখা যায়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আটটি জেলার প্রায় সাড়ে আট লাখ হেক্টর জমি নিয়ে হাওর অঞ্চল গঠিত। দেশের মোট আয়তনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জুড়ে রয়েছে এই হাওর অঞ্চল—যেখানে বাস করে প্রায় দুই কোটি মানুষ।

হাওর অঞ্চলের বিশালতা এবং এর বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের মাধ্যমে হাওর ও জলাভূমি এলাকার জনগণের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠনের নির্দেশ প্রদান করেন। পরবর্তীকালে ১৯৭৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়; কিন্তু হাওর এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের যে স্বপ্ন নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলত ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বোর্ডটি বিলুপ্ত করা হয়। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়ে। হাওর এলাকার মানুষ শিক্ষা-দীক্ষা থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে পিছিয়ে পড়ে।

সেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় আনয়নের মহান লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৮ সালের ৩ অক্টোবর কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইনে এক জনসভায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওর ও জলাভূমি এলাকার উন্নয়নে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি দুইটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ এবং বোর্ডের ‘কার্যনির্বাহী কমিটি’ গঠন করা হয়। পরে হাওর ও জলাভূমি এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ১৭ নভেম্বর হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডকে অধিদপ্তর ঘোষণার নির্দেশ প্রদান করেন। হাওর এলাকার মানুষের সার্বিক উন্নয়নের কথা বিবেচনায় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। শুরু হয় হাওর ও জলাভূমি এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নের এক বৈপ্লবিক সূচনা। তারই ধারাবাহিকতায় হাওর এলাকার জনজীবন, জীবিকা, পরিবেশ-প্রতিবেশসহ সার্বিক উন্নয়নের জন্য ২০১২ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত মোট ২০ বছর মেয়াদি একটি হাওর মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।

হাওর কৃষি : বাংলাদেশের মোট ধান উত্পাদনের একটি বড় অংশ আসে হাওর থেকে। এটি বাংলাদেশের মোট ধান উত্পাদনের প্রায় ১৬% এবং এর মূল্য জাতীয় আয়ের প্রায় ৬-৮ ভাগ। ধান ছাড়াও এ অঞ্চলে আলু, বাদাম, মিষ্টি আলু, সরিষা, ডাল জাতীয় সবজি ইত্যাদি উত্পাদিত হয়; কিন্তু আগাম বন্যার কারণে হাওরে প্রায়শই ধান উত্পাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কৃষকরা দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়ে। আকস্মিক বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ধান চাষের এ ক্ষতি হ্রাস করতে হলে হাওর অঞ্চলের কৃষকের পছন্দমতো উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করার কার্যক্রম গতিশীল করতে হবে এবং সেই সঙ্গে কৃষক পর্যায়ে স্বল্পমেয়াদি উন্নত জাতের ধানের বীজ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

হাওর অঞ্চলের কৃষি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেকটা ভিন্নতর। অনেক বৈচিত্র্য ও সীমাবদ্ধতার কারণে সেখানে ফসল উত্পাদন যেমন কষ্টকর, তেমনি পর্যাপ্ত মূলধন, হাওর অঞ্চলের চাষ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান এবং ফসল বিপণনের ধারণার অভাবে কৃষক প্রায়শই ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। এসব বিবেচনায় হাওরের কৃষিকে টেকসই করার জন্য জরুরিভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

হাওর হচ্ছে সারা বাংলাদেশের জন্য একটি ইকোসিস্টেম সার্ভিসের আধার। যারা এই সার্ভিসটা প্রদান করছে, তারাই বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র, সুতরাং তাদেরকে কীভাবে কমপেনসেট করা যায় সেই বিবেচনা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। যদিও বাংলাদেশে শস্যবীমা ব্যবস্থা নেই; কিন্তু হাওরের আগাম বন্যার জন্য শস্যবীমা নীতি গ্রহণ করা উচিত। একইসঙ্গে যদি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জীবনকালের শস্য চাষের ব্যবস্থা করা যায় তা আরো কার্যকর হবে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ : হাওর অঞ্চলে শ্রমিক সংকট নিরসন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্য কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। হাওর অঞ্চলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ উত্সাহিত করার লক্ষ্যে ভর্তুকি দিয়ে মেশিন দেওয়া হচ্ছে। হাওর অঞ্চলের জন্য উপযোগী মেশিন পাওয়া যায় না—এটা ঠিক নয়। যন্ত্রপাতির দাম একটু বেশি হওয়ার কারণে ঋণ সুবিধা সম্প্রসারণ করতে হবে—যাতে কৃষকরা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে তা কিনতে পারে।

মত্স্য সম্পদ : হাওর এলাকার দুই কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেশের আহরিত মাছের শতকরা ২০ ভাগের জোগান আসে হাওরের স্বচ্ছ ও সুস্বাদু পানি থেকে। বর্ষাকালে বিস্তীর্ণ হাওর হয়ে ওঠে মত্স্য প্রজননের অভয়ারণ্য। হাওরের পানিতে ২৬০টি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রয়েছে। তাছাড়া সেখানে ২৪ প্রজাতির চিংড়িরও সন্ধান পাওয়া গেছে। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মাছ উত্পাদনের প্রায় ১৭.৩৮ ভাগ ছিল হাওর অঞ্চলের। তবে গুণগত মানসম্পন্ন মাছের পোনার অভাবে অনেক সময়েই মাছের উত্পাদন ব্যাহত হয়। গুণগত মানসম্পন্ন মাছের পোনা সরবরাহের মাধ্যমে Captured Culture এবং Open Culture এর ব্যবস্থা জোরদার করা যেতে পারে। তাই, প্রজনন মওসুমে জেলেদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে—যাতে তারা মা মাছ ধরা বন্ধ রাখে। এতে করে হাওরে মাছের উত্পাদন বৃদ্ধি পাবে। মাছের প্রাকৃতিক বিচরণের পথগুলো চালু রাখতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই তা বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। যেহেতু মাছ চাষ হাওর অঞ্চলের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উত্স, সেহেতু মত্স্য চাষকে আমাদের বহুমুখীকরণ করতে হবে।

পানি ব্যবস্থাপনা : হাওর অঞ্চলে বছরে প্রায় দুই থেকে পাঁচ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। কৃষি উত্পাদনে, মাছ উত্পাদনে এবং অন্যান্য অ্যাকোয়াকালচার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায়ও বৃষ্টিপাতের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। অন্যদিকে, হাওর অঞ্চলে ক্রসবর্ডার নদী আছে ১৫টি। ফলে পানি এত দ্রুত আসে যে এর পূর্বাভাস দেওয়া অত্যন্ত কঠিন এবং কোনো মডেল দিয়েই এর আগাম তথ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই আগাম বন্যার পূর্বাভাস কিভাবে দেওয়া যায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সে বিষয়ে গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, হাওর যে পানি রিটেইন করে সে পানি যদি বাঁধ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে দেশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে। পলির বিষয়টিও আমাদের অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে কেন না পলির মধ্যেই থাকে মাটির পুষ্টি। সুতরাং পলি এবং পানির একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

হাওর স্যানিটেশন : হাওর স্যানিটেশনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাওর অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যাতে পুরোপুরি স্যানিটেশনের আওতায় আসে সেই বিষয়টিও বর্তমান সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে।

হাওরে যোগাযোগ ব্যবস্থা : হাওর অঞ্চলে ফসলমুখী রাস্তা নির্মাণের একটি চাহিদা রয়েছে। এখানে সমস্যা হচ্ছে- কোনো এলাকার মানুষ চায় বাম দিক দিয়ে রাস্তা, আবার কেউ চায় ডান দিক দিয়ে রাস্তা। তবে এক্ষেত্রে যেটি ভালো হতে পারে সেটি হলো-একটি কেন্দ্র ঠিক করে তার চারপাশে ফসলমুখী ডুবা রাস্তা নির্মাণ করা। হাওর এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো বাড়াতে হলে সেখানে কানেকটিভিটি দিতে হবে। কানেকটিভিটি দিতে গেলে ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই ক্ষতির মাত্রা কমানোর জন্য হাওর অঞ্চলের উপযোগী কানেকটিভিটি দিতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ এবং গ্রোথ সেন্টারের জন্য সাবমারজিবল সড়ক নির্মাণ করতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে সেগুলোকে ফ্লাইওভারে রূপান্তরের সম্ভাব্যতা যাচাই করা যেতে পারে।

প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার ব্যবহার : হাওর এলাকার একটি বড় সমস্যা হচ্ছে শ্রমিকের অপ্রতুলতা। মানুষ যখন শিক্ষিত হচ্ছে তখন সে সরাসরি চাষাবাদ বা জেলের কার্যক্রমে আগ্রহী হবে না। তবে যদি আধুনিক উপায়ে কোনো না কোনোভাবে তাকে উত্সাহিত করা যায়, যদি উদ্যোক্তা বানানো যায়, প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী করা যায়, তাহলে সে তার নিজ এলাকায় ফিরে যেতে পারে। এ জায়গায় আমরা পিছিয়ে আছি অর্থাত্ আধুনিক লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের নিকট পৌঁছে দেওয়ার কিছুটা দুর্বলতা আমাদের রয়েছে।

ইকোট্যুরিজম : হাওর অঞ্চলের স্বকীয়তা বজায় রেখে হাওরের যে সম্পদ আছে তাকে যদি ট্যুরিজমে কনভার্ট করতে পারি, তাহলে হাওর অর্থনীতিতে একটি গতির সঞ্চার হবে। বিশেষ করে হাওরে হোটেল ব্যবস্থা চালু করা উচিত, এক্ষেত্রে ভারতের কেরালার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। কৃষি এবং মত্স্য চাষের বাইরেও যে হাওরে মানুষের জন্য আয়বর্ধক কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন নিয়ে হাওর উন্নয়ন বোর্ডের গোড়াপত্তন করেছিলেন তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরে রূপান্তরের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনারবাংলা বিনির্মাণে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করছেন। হাওরে কৃষি যেহেতু একটি বড় খাত, সেহেতু রিপ্রোডাকটিভ পর্যায়ে কোল্ড ইনজুরি সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন, কৃষি বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ জরুরি। হাওরের ইকোসিস্টেম যথাযথভাবে বজায় রেখে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিশেষ করে ক্রসওয়ে/ভায়া সড়ক নির্মাণ করতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওরের জনগণের বিষয়ে সবসময়ই চিন্তা করেন। তাঁরই নির্দেশনায় হাওর অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য ২০ বছর মেয়াদি হাওর মহাপরিকল্পনা (মাস্টার প্ল্যান) প্রণয়ন করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ ইতোমধ্যে প্রণীত হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি, উভয় পরিকল্পনা সমন্বয়ের মাধ্যমে হাওর এলাকার জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে এবং একই সঙ্গে হাওরের জনগোষ্ঠীর জন্য বহুমুখী কর্মকাণ্ডের একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে হাওর অর্থনীতি

আপডেট টাইম : ০১:১৭:৪৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ হাওর হলো বৃহদাকার অগভীর জলাশয়। প্রাকৃতিকভাবে ভূগাঠনিক অবনমনের ফলে হাওরের সৃষ্টি। বর্ষাকালে এর জলরাশির ব্যাপ্তি কূলহীন সমুদ্রের আকার ধারণ করে। শীতকালে তা শুকিয়ে গিয়ে এবং সংকুচিত হয়ে দিগন্ত বিস্তৃত শ্যামল প্রান্তরে রূপ নেয়। বিভিন্ন কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি ও অর্থনীতিতে হাওর অনেক গুরুত্ব বহন করে। বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে হাওর দেখা যায়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আটটি জেলার প্রায় সাড়ে আট লাখ হেক্টর জমি নিয়ে হাওর অঞ্চল গঠিত। দেশের মোট আয়তনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জুড়ে রয়েছে এই হাওর অঞ্চল—যেখানে বাস করে প্রায় দুই কোটি মানুষ।

হাওর অঞ্চলের বিশালতা এবং এর বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের মাধ্যমে হাওর ও জলাভূমি এলাকার জনগণের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠনের নির্দেশ প্রদান করেন। পরবর্তীকালে ১৯৭৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়; কিন্তু হাওর এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের যে স্বপ্ন নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলত ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বোর্ডটি বিলুপ্ত করা হয়। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়ে। হাওর এলাকার মানুষ শিক্ষা-দীক্ষা থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে পিছিয়ে পড়ে।

সেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় আনয়নের মহান লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৮ সালের ৩ অক্টোবর কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইনে এক জনসভায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওর ও জলাভূমি এলাকার উন্নয়নে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি দুইটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ এবং বোর্ডের ‘কার্যনির্বাহী কমিটি’ গঠন করা হয়। পরে হাওর ও জলাভূমি এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ১৭ নভেম্বর হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডকে অধিদপ্তর ঘোষণার নির্দেশ প্রদান করেন। হাওর এলাকার মানুষের সার্বিক উন্নয়নের কথা বিবেচনায় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। শুরু হয় হাওর ও জলাভূমি এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নের এক বৈপ্লবিক সূচনা। তারই ধারাবাহিকতায় হাওর এলাকার জনজীবন, জীবিকা, পরিবেশ-প্রতিবেশসহ সার্বিক উন্নয়নের জন্য ২০১২ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত মোট ২০ বছর মেয়াদি একটি হাওর মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।

হাওর কৃষি : বাংলাদেশের মোট ধান উত্পাদনের একটি বড় অংশ আসে হাওর থেকে। এটি বাংলাদেশের মোট ধান উত্পাদনের প্রায় ১৬% এবং এর মূল্য জাতীয় আয়ের প্রায় ৬-৮ ভাগ। ধান ছাড়াও এ অঞ্চলে আলু, বাদাম, মিষ্টি আলু, সরিষা, ডাল জাতীয় সবজি ইত্যাদি উত্পাদিত হয়; কিন্তু আগাম বন্যার কারণে হাওরে প্রায়শই ধান উত্পাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কৃষকরা দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়ে। আকস্মিক বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ধান চাষের এ ক্ষতি হ্রাস করতে হলে হাওর অঞ্চলের কৃষকের পছন্দমতো উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করার কার্যক্রম গতিশীল করতে হবে এবং সেই সঙ্গে কৃষক পর্যায়ে স্বল্পমেয়াদি উন্নত জাতের ধানের বীজ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

হাওর অঞ্চলের কৃষি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেকটা ভিন্নতর। অনেক বৈচিত্র্য ও সীমাবদ্ধতার কারণে সেখানে ফসল উত্পাদন যেমন কষ্টকর, তেমনি পর্যাপ্ত মূলধন, হাওর অঞ্চলের চাষ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান এবং ফসল বিপণনের ধারণার অভাবে কৃষক প্রায়শই ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। এসব বিবেচনায় হাওরের কৃষিকে টেকসই করার জন্য জরুরিভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

হাওর হচ্ছে সারা বাংলাদেশের জন্য একটি ইকোসিস্টেম সার্ভিসের আধার। যারা এই সার্ভিসটা প্রদান করছে, তারাই বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র, সুতরাং তাদেরকে কীভাবে কমপেনসেট করা যায় সেই বিবেচনা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। যদিও বাংলাদেশে শস্যবীমা ব্যবস্থা নেই; কিন্তু হাওরের আগাম বন্যার জন্য শস্যবীমা নীতি গ্রহণ করা উচিত। একইসঙ্গে যদি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জীবনকালের শস্য চাষের ব্যবস্থা করা যায় তা আরো কার্যকর হবে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ : হাওর অঞ্চলে শ্রমিক সংকট নিরসন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্য কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। হাওর অঞ্চলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ উত্সাহিত করার লক্ষ্যে ভর্তুকি দিয়ে মেশিন দেওয়া হচ্ছে। হাওর অঞ্চলের জন্য উপযোগী মেশিন পাওয়া যায় না—এটা ঠিক নয়। যন্ত্রপাতির দাম একটু বেশি হওয়ার কারণে ঋণ সুবিধা সম্প্রসারণ করতে হবে—যাতে কৃষকরা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে তা কিনতে পারে।

মত্স্য সম্পদ : হাওর এলাকার দুই কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেশের আহরিত মাছের শতকরা ২০ ভাগের জোগান আসে হাওরের স্বচ্ছ ও সুস্বাদু পানি থেকে। বর্ষাকালে বিস্তীর্ণ হাওর হয়ে ওঠে মত্স্য প্রজননের অভয়ারণ্য। হাওরের পানিতে ২৬০টি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রয়েছে। তাছাড়া সেখানে ২৪ প্রজাতির চিংড়িরও সন্ধান পাওয়া গেছে। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মাছ উত্পাদনের প্রায় ১৭.৩৮ ভাগ ছিল হাওর অঞ্চলের। তবে গুণগত মানসম্পন্ন মাছের পোনার অভাবে অনেক সময়েই মাছের উত্পাদন ব্যাহত হয়। গুণগত মানসম্পন্ন মাছের পোনা সরবরাহের মাধ্যমে Captured Culture এবং Open Culture এর ব্যবস্থা জোরদার করা যেতে পারে। তাই, প্রজনন মওসুমে জেলেদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে—যাতে তারা মা মাছ ধরা বন্ধ রাখে। এতে করে হাওরে মাছের উত্পাদন বৃদ্ধি পাবে। মাছের প্রাকৃতিক বিচরণের পথগুলো চালু রাখতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই তা বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। যেহেতু মাছ চাষ হাওর অঞ্চলের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উত্স, সেহেতু মত্স্য চাষকে আমাদের বহুমুখীকরণ করতে হবে।

পানি ব্যবস্থাপনা : হাওর অঞ্চলে বছরে প্রায় দুই থেকে পাঁচ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। কৃষি উত্পাদনে, মাছ উত্পাদনে এবং অন্যান্য অ্যাকোয়াকালচার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায়ও বৃষ্টিপাতের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। অন্যদিকে, হাওর অঞ্চলে ক্রসবর্ডার নদী আছে ১৫টি। ফলে পানি এত দ্রুত আসে যে এর পূর্বাভাস দেওয়া অত্যন্ত কঠিন এবং কোনো মডেল দিয়েই এর আগাম তথ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই আগাম বন্যার পূর্বাভাস কিভাবে দেওয়া যায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সে বিষয়ে গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, হাওর যে পানি রিটেইন করে সে পানি যদি বাঁধ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে দেশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে। পলির বিষয়টিও আমাদের অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে কেন না পলির মধ্যেই থাকে মাটির পুষ্টি। সুতরাং পলি এবং পানির একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

হাওর স্যানিটেশন : হাওর স্যানিটেশনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাওর অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যাতে পুরোপুরি স্যানিটেশনের আওতায় আসে সেই বিষয়টিও বর্তমান সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে।

হাওরে যোগাযোগ ব্যবস্থা : হাওর অঞ্চলে ফসলমুখী রাস্তা নির্মাণের একটি চাহিদা রয়েছে। এখানে সমস্যা হচ্ছে- কোনো এলাকার মানুষ চায় বাম দিক দিয়ে রাস্তা, আবার কেউ চায় ডান দিক দিয়ে রাস্তা। তবে এক্ষেত্রে যেটি ভালো হতে পারে সেটি হলো-একটি কেন্দ্র ঠিক করে তার চারপাশে ফসলমুখী ডুবা রাস্তা নির্মাণ করা। হাওর এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো বাড়াতে হলে সেখানে কানেকটিভিটি দিতে হবে। কানেকটিভিটি দিতে গেলে ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই ক্ষতির মাত্রা কমানোর জন্য হাওর অঞ্চলের উপযোগী কানেকটিভিটি দিতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ এবং গ্রোথ সেন্টারের জন্য সাবমারজিবল সড়ক নির্মাণ করতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে সেগুলোকে ফ্লাইওভারে রূপান্তরের সম্ভাব্যতা যাচাই করা যেতে পারে।

প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার ব্যবহার : হাওর এলাকার একটি বড় সমস্যা হচ্ছে শ্রমিকের অপ্রতুলতা। মানুষ যখন শিক্ষিত হচ্ছে তখন সে সরাসরি চাষাবাদ বা জেলের কার্যক্রমে আগ্রহী হবে না। তবে যদি আধুনিক উপায়ে কোনো না কোনোভাবে তাকে উত্সাহিত করা যায়, যদি উদ্যোক্তা বানানো যায়, প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী করা যায়, তাহলে সে তার নিজ এলাকায় ফিরে যেতে পারে। এ জায়গায় আমরা পিছিয়ে আছি অর্থাত্ আধুনিক লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের নিকট পৌঁছে দেওয়ার কিছুটা দুর্বলতা আমাদের রয়েছে।

ইকোট্যুরিজম : হাওর অঞ্চলের স্বকীয়তা বজায় রেখে হাওরের যে সম্পদ আছে তাকে যদি ট্যুরিজমে কনভার্ট করতে পারি, তাহলে হাওর অর্থনীতিতে একটি গতির সঞ্চার হবে। বিশেষ করে হাওরে হোটেল ব্যবস্থা চালু করা উচিত, এক্ষেত্রে ভারতের কেরালার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। কৃষি এবং মত্স্য চাষের বাইরেও যে হাওরে মানুষের জন্য আয়বর্ধক কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন নিয়ে হাওর উন্নয়ন বোর্ডের গোড়াপত্তন করেছিলেন তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরে রূপান্তরের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনারবাংলা বিনির্মাণে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করছেন। হাওরে কৃষি যেহেতু একটি বড় খাত, সেহেতু রিপ্রোডাকটিভ পর্যায়ে কোল্ড ইনজুরি সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন, কৃষি বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ জরুরি। হাওরের ইকোসিস্টেম যথাযথভাবে বজায় রেখে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিশেষ করে ক্রসওয়ে/ভায়া সড়ক নির্মাণ করতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওরের জনগণের বিষয়ে সবসময়ই চিন্তা করেন। তাঁরই নির্দেশনায় হাওর অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য ২০ বছর মেয়াদি হাওর মহাপরিকল্পনা (মাস্টার প্ল্যান) প্রণয়ন করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ ইতোমধ্যে প্রণীত হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি, উভয় পরিকল্পনা সমন্বয়ের মাধ্যমে হাওর এলাকার জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে এবং একই সঙ্গে হাওরের জনগোষ্ঠীর জন্য বহুমুখী কর্মকাণ্ডের একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।